• মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪২ অপরাহ্ন
শিরোনাম
ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নির্ধারণের এখতিয়ার একমাত্র বিএমডিসির। ভুল চিকিৎসা নয়, ঔষধের বিরল রিঅ্যাকশনে অসুস্থ শিক্ষার্থী। ডা: ইকবাল হোসেন আমান। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে বারিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পন্ন। জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন বরিশাল জেলার কমিটি অনুমোদন। বরিশাল দক্ষিণ জেলা যুবদলের প্রতিবাদ। সরকারী নিয়মভঙ্গ করে শিক্ষকের মাদ্রাসা বাণিজ্য!! সংবাদ প্রকাশের পর দৌড়ঝাপ শুরু ব্যাংক ম্যানেজার জসিমের!! বরিশাল প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে জাল তথ্য দিয়ে লোন: দায় এড়াতে সেকেন্ড অফিসারকে ফাঁসানোর অভিযোগ!! আদালতের শোকজ নোটিশের মুখে সিলেটের ডিসি সারওয়ার আলম।

বাংলাদেশের আধুনিক নজরদারি: গোপনীয়তা, স্পাইওয়্যার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ!!

প্রতিনিধি / ১৩৩ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

অনলাইন ডেস্ক :
সাম্প্রতিক এক গভীর গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নজরদারি ব্যবস্থার যে রূপান্তর ঘটেছে, তা স্বাধীনতার পর থেকে একটি বড় ধাক্কা। দেশের পুলিশি ও গোয়েন্দা কাঠামো উপনিবেশিক যুগের প্রথাগত মডেল থেকে আধুনিক সাইবার নজরদারি সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে গত দশকের মধ্যে, নজরদারির প্রযুক্তি ও কার্যক্রম ব্যাপক পরিধিতে বিস্তার লাভ করেছে, যা এখন শুধু অপরাধ দমন নয়, বরং রাজনৈতিক বিরোধিতা,সাংবাদিকতা,নাগরিক অধিকার ও স্বাধীন মত প্রকাশের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থা শুরুর দিকে ছিল শারীরিক পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে এখন এটি আধুনিক সাইবার সক্ষমতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। মেটাডাটা বিশ্লেষণ, রিয়েল-টাইম যোগাযোগ আটকানো, দূর থেকে নজরদারি, কনটেন্ট ফিল্টারিং এবং ডিজিটাল ডিভাইস হ্যাকিং এর মতো উন্নত পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশেষ করে ২০০১ সালের ৯/১১ এর পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী নীতি এবং ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান বেকারির সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে এই প্রযুক্তিগুলো ক্রমশ দ্রুতগতিতে আমদানি ও প্রয়োগ শুরু হয়।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ১৬০ ধরনের নজরদারি প্রযুক্তি বাংলাদেশে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে IMSI ক্যাচার, ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টর, Cellebrite, FinFisher, Predator স্পাইওয়্যার। এসব প্রযুক্তি রাষ্ট্রীয় নজরদারি কার্যক্রমকে গোপনীয় ও অধিক ক্ষমতাশালী করে তুলেছে, অনেক সময় আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াই ব্যবহৃত হচ্ছে।

সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া ও আমদানিতে স্বচ্ছতার অভাব থাকায় এসব প্রযুক্তির প্রকৃত পরিমাণ ও ব্যবহারের ব্যাপ্তি এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায়, এই প্রযুক্তিগুলো শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নয়, রাজনৈতিক বিরোধী ও সাধারণ নাগরিকের উপর নজরদারির জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কর্পোরেশন সাবেক বাংলাদেশের সরকারের কাছে নজরদারি প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো ইসরায়েলি প্রযুক্তির ব্যাপক আমদানি, যা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুর ও হাঙ্গেরির মতো তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় এসেছে। Cellebrite UFED NSO গ্রুপের Pegasus স্পাইওয়্যার সহ Intellexa Consortium-এর প্রযুক্তি গোপনে ঢুকেছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে নজরদারি ও স্পাইওয়্যার প্রযুক্তির জন্য ২০১৫-২৫ সালের মধ্যে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ইসরায়েলি প্রযুক্তির জন্য প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (NTMC) একাই এ খাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা অন্তর্ভুক্ত করে ডিপ প্যাকেট ইন্সপেকশন (DPI), কনটেন্ট ফিল্টারিং, ইন্টারনেট ট্রাফিক আটকানো ও স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি। পুলিশ ও র‍্যাব ওয়াই-ফাই ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ইন্টারসেপশন, সিগন্যাল জ্যামিংয়ের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। DGFI মোবাইল নেটওয়ার্ক মনিটরিং ও সিগন্যাল জ্যামিংয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।
২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে নজরদারি প্রযুক্তি কেনার হার বেড়ে গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় এসব প্রযুক্তি রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন, প্রার্থী ও সমাবেশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে।
বিশেষত জিওলোকেশন ট্র্যাকিং এবং ডেটা এক্সট্রাকশন টুল ব্যবহার করে বিরোধীদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়েছে। বিক্ষোভ ও গণআন্দোলনের সময়ও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিদের নিরীক্ষণ ও সনাক্তকরণ কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান নজরদারি প্রক্রিয়ার মূল চালিকা শক্তি হলো স্পাইওয়্যার, বিশেষ করে Cellebrite UFED যা মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে ডেটা সংগ্রহ, ডিকোড ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম।
২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় বাংলাদেশ এমন দেশগুলোর মধ্যে ছিল যেখানে NSO গ্রুপের Pegasus স্পাইওয়্যার শনাক্ত হয়েছিল। ইসরায়েলি কোম্পানি Coralco Tech এর মাধ্যমে DGFI কে ১.৬ মিলিয়ন ডলারের স্পাইওয়্যার বিক্রি করা হয়েছে।

UTX Technologies (বর্তমানে Verint Systems) NTMC কে ওয়েব ইন্টেলিজেন্স ও মোবাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশ ও ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও, সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুর ও হাঙ্গেরি’র মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি প্রবাহিত হয়েছে।

কমপক্ষে ৯টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্পাইওয়্যার বিক্রেতা, যার মধ্যে নিষিদ্ধ NSO গ্রুপ, Intellexa Consortium ও Cytrox সংস্থাও রয়েছে, বাংলাদেশে নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করেছে।

এই ডিজিটাল নজরদারি অবকাঠামো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি—নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণহীন এই ব্যবস্থার ফলে সাধারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক কর্মীরা অনবরত নজরদারির শিকার হচ্ছেন।

গবেষণাটি বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থার অপব্যবহার ও পরিধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে:
১. নজরদারি প্রযুক্তির ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার সম্পর্কে সরকারি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

২. নজরদারি ব্যবস্থার আইনি কাঠামো আপডেট করে নাগরিক অধিকার ও গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ স্পাইওয়্যার ও নজরদারি প্রযুক্তির আমদানি রোধে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. রাজনৈতিক বিরোধীদের নজরদারি বন্ধ করে মুক্ত মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্রের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এটি শুধুমাত্র নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এটি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি গম্ভীর সংকট।

এই সংকট থেকে উত্তরণে আইনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই একমাত্র পথ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...

https://slotbet.online/